আজ ১৩ নভেম্বর, শোকাবহ ‘‘হাতিয়া গণহত্যা দিবস”। ১৯৭১ সালের এই দিনে কুড়িগ্রামের উলিপুরের হাতিয়া ইউনিয়নের দাঁগারকুটি গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহযোগী রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস বাহিনী মিলে নারকীয় গণহত্যা চালায়। এ দিন ভোরে ঘুমন্ত অবস্থায় ধরে এনে নিরীহ ৬৯৭ জন গ্রামবাসীকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি না পেলেও, উলিপুরবাসীর কাছে আজও চিরস্মরণীয়।
১৯৭১ সালের ২৩ রমজান, শনিবার—গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ সেহরী শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বা নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঠিক তখনই ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত দাগারকুটি গ্রামে মর্টার সেল ও বন্দুকের গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ফজরের আজানের ধ্বনির মধ্যেই আক্রমণ শুরু করে হানাদার বাহিনী। মুহূর্তেই গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয় তারা, চলে লুটপাট ও নির্যাতন। হতভাগা মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে জীবন বাঁচাতে ধানক্ষেত ও ঝোপঝাড়ে লুকানোর চেষ্টা করেন। অনেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালাতে চেয়েও ব্যর্থ হন।
এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে বৃদ্ধ ও মায়ের কোলে থাকা শিশুরাও রেহাই পায়নি। দিনভর চলা এই হত্যাকাণ্ডে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে হাত-পা বেঁধে দাঁগারকুটি গ্রামের এক স্থানে জড়ো করে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, কিন্তু হানাদারদের নিষ্ঠুরতার কাছে সবাই অসহায় হয়ে পড়ে।
এই ভয়াবহ গণহত্যার স্মরণে দাগারকুটি গ্রামে স্থানীয় জনগণ একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে, যেখানে প্রতিবছর শহীদদের স্মরণ করা হয়। তবে শহীদ পরিবারের স্বজনদের দাবি, হাতিয়া গণহত্যা দিবসকে জাতীয় পর্যায়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হোক। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্ত শহীদ পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও পুনর্বাসন দেওয়া হোক।
সেদিনের বীভৎসতা আর ধ্বংসযজ্ঞের সাক্ষী হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর, দাগারকুটি, হাতিয়া বকসি, রামখানা ও নয়াদাড়া গ্রামের ঘরবাড়ি আজও সেই ভয়াবহ স্মৃতি বহন করছে। পাকিস্তানি বাহিনীর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া এই গ্রামগুলো আজ শুধুই স্মৃতি, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে উলিপুরের মানুষদের মনে গভীর শোকের ক্ষত রেখে গেছে।
হাতিয়া গণহত্যা দিবস উপলক্ষে উলিপুর উপজেলা প্রশাসন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা দিনটি পালন করেন। যদিও বছরের পর বছর কেটে গেছে, কিন্তু এই বেদনার স্মৃতি কখনো মুছে যাবে না। শহীদের স্বজনরা আজও আপনজনদের হারানোর ব্যথা বুকে ধারণ করে নিরবে-নিভৃতে তাদের স্মরণ করছেন।
এই গণহত্যা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এখন সময় এসেছে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি দিয়ে শহীদ পরিবারদের পাশে দাঁড়ানোর।
ভিসি/এএস
আপনার মতামত লিখুন :