সর্বশেষ :

নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণে প্রয়োজন গবেষণা ভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা


সাঈদ মুহাম্মাদ সানোয়ার
অক্টোবর ২৪, ২০২৪ । ৫:১২ অপরাহ্ণ
নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণে প্রয়োজন গবেষণা ভিত্তিক উচ্চ শিক্ষা
সংগৃহীত ছবি

গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন একটি বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছরের অপশাসনে দেশের সবধরনের প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাখাতও এর বাহিরে ছিল না। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা সর্বত্র বৈষম্য ছিল প্রকট রূপে। স্বাধীনতার পর থেকে দফায় দফায় শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সার্থক ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার সম্ভব হয় নি। বাস্তবায়ন করা যায় নি মানসম্মত শতভাগ প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা। পরিবর্তশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে গবেষণা ভিত্তিক উচ্চশিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি।

এ যাবৎকালে শিক্ষা খাতে সরকারি বরাদ্দ ছিল খুবই নগন্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির এক দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল দুই দশমিক ০৮ শতাংশ, যা জাতিসংঘের সুপারিশকৃত সর্বনিম্ন ৪ শতাংশেরও অনেক নিচে। ফলে কোচিং-প্রাইভেট নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সিংহভাগ খরচ বহন করতে হয় শিক্ষার্থীদের। ইউনেসকোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট-২০২২ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১% বহন করে শিক্ষার্থীরা, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। শিক্ষার্থীকেন্দ্রীক ব্যয়বহুল এই শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র কিংবা কম সামর্থ্যবান অভিভাবকের সন্তান ধনী পরিবারের সন্তানের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। অত্যধিক শিক্ষা ব্যয় বহন করতে না পেরে গরিব শিক্ষার্থীদের বিরাট অংশ ঝরে পড়ছে প্রতিবছরই। এভাবেই বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা শ্রেণি-বৈষম্য তৈরি করে রেখেছে।

অত্যাধিক ব্যয়বহুল হওয়ার পরেও বাংলাদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস এর মতে, মালিক ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের জন্য টাকা বানানো ও পাচারের জায়গা হচ্ছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অনেকের মতে হাতে গোনা কয়েকটা বাদে বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যলয়গুলো সার্টিফিকেট বিক্রির কারখানায় পরিণত হয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শক্ত করে ধরতে সরকারকে পরামর্শ দেন অধ্যাপক রোবায়েত ।

এদিকে একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হলেও সেগুলোতে শিক্ষার কোনো মান বৃদ্ধি পায় নি। ক্লাসরুম, শিক্ষক, ল্যাব, হল, পরিবহন সংকট তীব্র আকারে বিরাজ করছে প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্বমানের গবেষণা হয় না বললেই চলে। একটি জ্ঞান ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মানের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকৃত, কার্যকর ও প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করা। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার মাধ্যমে প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জনের দিকে জোর দিতে হবে।

উচ্চ শিক্ষার অন্যতম পূর্বশর্ত গবেষণা। একমাত্র গবেষণার মাধ্যমেই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রবেশ করতে পারে। বিশ্বের দশটি শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আটটিই যুক্তরাষ্ট্রের দখলে। উনিশ শতকের পর তারা গবেষণাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিস্তার লাভ করে এবং হয়ে ওঠে সারা বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ।

টাইমস হায়ার এডুকেশনের সূত্রানুযায়ী, গবেষণা ক্ষাতে উল্লেখ যোগ্য সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চীনের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে। এছাড়া সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশ ওয়ার্ল্ড র‌্যাংকিং এ ভালো অবস্থানে রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকে বরাবরই ভালো করছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। মূলত প্রশিক্ষণ ও গবেষণার পর্যাপ্ত সুবিধার পাশাপাশি মানসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান, অত্যাধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া, যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা আর সুশাসিত ও জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা দেশগুলোকে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রেখেছে।

যদি বিশ্বের নোবেল বিজয়ীদের দিকে তাকাই, তাহলে তাদের প্রত্যেকেই গবেষণার সাথে জড়িত ছিলেন বা আছেন এবং প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সুইডেন, ইংল্যান্ড, জাপান কিংবা জার্মান এদিক দিয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছেন। এই উদাহরণের মাধ্যমেও আধুুনিক সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার মূল্য কতখানি তা অনুমেয়।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শিক্ষাখাতে ব্যাপক সংস্কারের যে অঙ্গীকার নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে, সেখানে জাতীয় শিক্ষানীতিতে গবেষণাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের মধ্যে গবেষণা বিষয়ে সচেতনা ও উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও এখনো গবেষণায় বহুবিধ সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। নোবেল বিজয়ী প্রফেসর আব্দুস সালামকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তৃতীয় বিশ্বের গরীব দেশে কেনো বিশ্বমানের গবেষণা হয় না? এক বাক্যের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “রিসার্চ ইজ এক্সপেনসিভ!”

শিক্ষা ও প্রযুক্তি মিলে একটি খাতে বাজেটে বরাদ্দ না দিয়ে শিক্ষাখাতের জন্য পৃথক বাজেট রাখা এখন সময়ের দাবি। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী শিক্ষা খাতে ৬ শতাংশ বা মোট বাজেটের অন্তত ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

গবেষণাই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির নীতিমালায় গবেষণাকে বাধ্যতামূলক করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি যুগোপযোগী বেতন স্কেল তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের যথাযথ বেতন-ভাতা নিশ্চিত করে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে এই সংকট সমাধান সম্ভব নয়।

পৃথিবীতে জ্ঞান ও চিন্তার অধিক দামী সম্পদ আর নেই। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে সেই জ্ঞান তৈরির কারখানা। আর গবেষণা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান পরিমাপকের মানদন্ড। প্রতিবছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। বিভিন্ন মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে তারা এ র‌্যাংকিং প্রকাশ করে। গবেষণা হচ্ছে সেই সব মানদন্ডের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুনগত মান বৃদ্ধি করতে গবেষণার পরিধি বাড়িয়ে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে আমাদের দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যে মেধা তা দিয়ে আমরা বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে বিষ্ময়কর বাংলাদেশ হিসেবে দাঁড় করাতে পারব।

লেখক,

সাঈদ মুহাম্মাদ সানোয়ার,

শিক্ষার্থী শিক্ষা বিভাগ,

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


ভিসি/এএস


পুরোনো সংখ্যা

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১