চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, আর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্তদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
২০২৪ সালে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামে ১,১৫১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, যার মধ্যে ১৩ জন মারা গেছেন। কেবল সেপ্টেম্বর মাসেই ৫৫৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মাসের শেষের দিকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ জনে। এই বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ক্রমাগত বেড়ে চলছে, জানুয়ারিতে ৬৯ জন এবং আগস্টে ২০২ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং বিশেষ করে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে বেশিরভাগই শহরের নাগরিক হলেও, বিভিন্ন উপজেলা থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তাঁর মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং মশার বংশবৃদ্ধি রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। তিনি আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ফগিং কার্যক্রম এবং পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সিভিল সার্জন অফিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসেই ৫৫৩ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে স্থানীয় পর্যায়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান ও ফগিং কার্যক্রম বাড়ানোর জন্য জোর দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোগীদের জন্য হাসপাতালগুলিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখার নির্দেশনা দিয়েছে, যাতে জরুরি চিকিৎসা প্রদান করা সম্ভব হয়।
অধিদপ্তর আরও জানিয়েছে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে, মশা নিধন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম চালানোর জন্য সিটি কর্পোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ডেঙ্গু প্রতিরোধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানিয়েছেন চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি।
তিনি বলেন, মশা নিধনের জন্য নিয়মিত ফগিং (কুয়াশা ছড়ানো) কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে, শহরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে এই কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা বাসাবাড়ির আশেপাশে জমে থাকা পানি অপসারণ এবং মশার লার্ভা ধ্বংসের কাজ করছেন।
সিটি কর্পোরেশন নাগরিকদের সচেতনতার জন্য বিভিন্ন প্রচারণাও চালাচ্ছে। তারা জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন তারা নিজেদের বাসাবাড়ি ও আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার রাখেন এবং জমে থাকা পানি যাতে না থাকে তা নিশ্চিত করেন। এছাড়াও, বাসিন্দাদের মশারি ব্যবহার এবং মশার কামড় থেকে বাঁচার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এই কার্যক্রমের পাশাপাশি, সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তরের সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য।
এদিকে, চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধির পেছনে মশার বংশবৃদ্ধি রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়াকে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন। বিশেষ করে নগরের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং বৃষ্টির পর জলাবদ্ধতা মশার প্রজননস্থল হিসেবে কাজ করছে।
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হচ্ছে, তাই সকলের সচেতনতা ও প্রশাসনের কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব হতে পারে। এ বিষয়ে সকলেরই বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
জনসাধারণের মধ্যে ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে:
১. মিডিয়া প্রচারণা: টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা এবং সামাজিক মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করা। বিশেষ করে ডেঙ্গুর লক্ষণ, প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রচারণা চালানো।গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ব্যানার, পোস্টার ও বিলবোর্ড স্থাপন করে ডেঙ্গু প্রতিরোধের পরামর্শ প্রদান করা।
২. জনসম্পৃক্ততা কার্যক্রম: বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার, স্কুল, কলেজ ও অফিসে সচেতনতামূলক আলোচনা সভা ও সেমিনার আয়োজন করা। প্রতিটি পাড়ায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে বাসাবাড়ি পরিদর্শন করে জমে থাকা পানি পরিষ্কার এবং মশার লার্ভা ধ্বংসে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান: জনসাধারণকে নিজ নিজ বাসাবাড়ি এবং আশেপাশের এলাকায় জমে থাকা পানি সরাতে উৎসাহিত করা।স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে যুক্ত করা যেতে পারে। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবে।
৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক কর্মসূচি: শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রতিরোধ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য স্কুল ও কলেজে বিশেষ কর্মশালা বা ক্যাম্পেইন আয়োজন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সচেতন করা যেতে পারে।
৫. মোবাইল অ্যাপ ও হটলাইন চালু: ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি অ্যাপ তৈরি করে, যেখানে ডেঙ্গু সম্পর্কে তথ্য, কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে এবং কোন লক্ষণে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত দেওয়া যেতে পারে।একটি হটলাইন চালু করে ডেঙ্গু সম্পর্কে জরুরি তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।
৬. লার্ভিসাইড কার্যক্রম: মশার লার্ভা ধ্বংস করার জন্য লার্ভিসাইড ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে এবং সাধারণ মানুষকে এটি ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত করা যেতে পারে।
এই পদক্ষেপগুলো ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে এবং ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
ভিসি/এএস
আপনার মতামত লিখুন :