গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশজুড়ে প্রশাসন, অর্থনীতি, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলাসহ বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য সংস্কার এবং পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন ও প্রশাসনের রদবদল
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। প্রশাসনের শীর্ষপদগুলোতে ব্যাপক রদবদল দেখা যায়। বহু কর্মকর্তা বদলি হয়েছেন, অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে, এবং শেখ হাসিনার আমলের অনুগত কর্মকর্তাদের পদ থেকে সরিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনে নতুন পরিবর্তন আনতে কাজ শুরু করেছে নতুন সরকার।
পুলিশ বাহিনীর মাঠে ফেরা ও নতুন সিদ্ধান্ত
শেখ হাসিনার পতনের পর পুলিশ বাহিনীতে অস্থিরতা দেখা দেয়। বিভিন্ন থানায় হামলা এবং পুলিশের মৃত্যুর ঘটনা ঘটার পর, বাহিনী কর্মবিরতি শুরু করে। তবে, ১৫ আগস্টের মধ্যে কাজে না যোগ দিলে চাকরি হারানোর শর্তের প্রেক্ষিতে পুলিশ কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে। নতুন আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম পুলিশ বাহিনীর মনোবল বাড়াতে পোশাক ও লোগো পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন।
বিচার বিভাগে রদবদল
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান পদত্যাগ করেন। নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ সময় অধ্যাপক ইউনূস এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল করা হয়। বিচার বিভাগে নতুন মুখ নিয়োগ এবং পুরনো মুখ বাদ দেওয়ার মধ্য দিয়ে এই বিভাগেও বড় পরিবর্তন এসেছে।
পদত্যাগের হিড়িক ও নতুন নিয়োগ
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের ঢেউ দেখা যায়। শেখ হাসিনার সরকারের অনেক শীর্ষ কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদত্যাগ করেছেন। একইভাবে, ইসলামী ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়।
শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে মামলা
শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য এবং তার সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সহ সরকারের বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-এমপি গ্রেপ্তার হয়েছেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন লুটপাটের অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। অর্থ পাচারকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এবং বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা ও অন্যান্য খাতে পরিবর্তন
সরকার পরিবর্তনের পর বন্ধ থাকা উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে এবং শিক্ষাখাতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গুম ও নিখোঁজদের ফেরত আসা
গুমের অভিযোগে ভুক্তভোগীদের দাবির মুখে সরকার একটি গুম তদন্ত কমিশন গঠন করেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মুক্তি পাওয়ার পর তারা তাদের আটকের বিষয়ে কথা বলা শুরু করেছেন, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বৃদ্ধির প্রতিফলন।
জনপ্রতিনিধিদের জায়গায় প্রশাসক
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যূতির পর মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। স্থানীয় সরকারের ওই চারটি প্রতিষ্ঠানের পদ থেকে মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হলেও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ক্ষেত্রে ভিন্ন নীতি সরকারের। যেসব জায়গায় চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন, সেখানে কাজ চালিয়ে নিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সক্রিয় জামায়াত
ক্ষমতা হারানোর চারদিন আগে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮ নম্বর ধারায় ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ও তাদের ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’কে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় বসার তৃতীয় সপ্তাহে এসে সিদ্ধান্ত বদলে গেছে। বাতিল করা হয়েছে আগের প্রজ্ঞাপন। ফলে দলটির নেতাকর্মীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
এদিকে, ক্ষমতা ছাড়ার পর উল্টো আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আদালতে রিট আবেদন করে ‘সারডা সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন। যদিও হাইকোর্ট সেই রিট আবেদেন খারিজ করে দিয়েছে।
১৫ অগাস্টের ছুটি বাতিল
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেওয়ার পর গত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুদিন ১৫ই অগাস্টে সারা দেশে ব্যাপক আয়োজনে শোকদিবস পালিত হতে দেখা গেছে। জাতীয় দিবস হিসেবে ওইদিন সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতার পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেটিও বদলে গেছে।
শপথ নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ১৫ই অগাস্টের সরকারি ছুটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় করে অন্তর্বর্তী সরকার। এ ঘটনার পর গত ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীকে দাঁড়াতে দেয়নি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কর্মী-সমর্থকরা।
নানান দাবিতে বিক্ষোভ-ঘেরাও
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরবর্তী প্রায় তিন সপ্তাহজুড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে নানান দাবিতে একের পর এক বিক্ষোভ-আন্দোলন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল অঙ্গীভূত আনসার সদস্যদের বিক্ষোভ।
‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল করে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গত ২৫শে অগাস্ট সারাদিন সচিবালয় অবরোধ করে রেখেছিলেন এই আধা-সামরিক বাহিনীর প্রায় দশ হাজার সদস্য।
আলোচনার মাধ্যমে বিকেলে সরকারের পক্ষ থেকে ‘রেস্ট প্রথা’ বাতিল ঘোষণা করা হলেও আন্দোলন থামাননি তারা। পরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের জড়িয়ে পড়েন আনসার সদস্যরা, যাতে উভয়পক্ষের অর্ধ-শতাধিক মানুষ আহত হয়।
অবরোধ ও সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার সাড়ে তিনশ’র বেশি আনসার সদস্যকে গ্রেফতার দেখিয়ে পরবর্তীতে কারাগারে পাঠানো হয়।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ আরও অনেক সরকারি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান ও ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও সচিবালয় আশপাশে সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে পুলিশ।
সেইসঙ্গে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ ও মৎস্যভবন সংলগ্ন এলাকাতেও সভা-সমাবেশ না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশের সামাজিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে কাজ করছে, যদিও ভবিষ্যতে এসব পরিবর্তনের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
ভিসি/এএস
আপনার মতামত লিখুন :