সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী পরিস্থিতিতে নতুন এক অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন প্রফেসর ইউনূস। এই সরকার জনগণের মাঝে আশার আলো জ্বালিয়েছে, বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা এতদিন ধরে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। জনগণ এখন এই সরকারের কাছ থেকে ন্যায়বিচার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপনের প্রত্যাশা করছে।
বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা জনগণের একটি বড় দাবি ছিল। তবে বিচার প্রক্রিয়ার কিছু দিক নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যে বিশেষত, ঢালাওভাবে মামলা দায়ের হওয়ায় প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। যারা সত্যিকারভাবে অপরাধ করেছে, তারা যেন কোনোভাবেই পার পেয়ে না যায়—এটা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। তাই বিচার প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করতে এবং দোষীদের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে আরও সতর্ক হতে হবে।
পূর্বের ফ্যাসিবাদী শাসনামলের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে, আমাদের বুঝতে হবে কেন সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিল, তবে পরবর্তীতে সেই সরকার কর্তৃত্ববাদী রূপ ধারণ করে। শেখ হাসিনার সরকার প্রথমে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীতে তারা জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে, যার ফলে তাদের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমে গেছে এবং একতরফা নির্বাচন ও ভোট কারচুপি করে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে, তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানে ফিরে আসেন, যার ফলে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যা জনগণের ভোটাধিকার হরণের একটি বড় উদাহরণ।
গত সরকারের ক্ষমতা অপব্যবহার এবং ভোটাধিকার হরণের ফলেই জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভ এবং অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
ভোটাধিকার মানুষের একটি মৌলিক অধিকার এবং নাগরিকত্বের প্রতিফলন। কিন্তু বিগত সরকার এই অধিকার হরণ করে, যার ফলে সরকারের জবাবদিহিতার কাঠামো ভেঙে পড়ে। সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ না থাকায় সরকার জনগণের চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষার প্রতি মনোযোগ দেয়নি। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবে সরকার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাটের আশ্রয় নেয়। এর ফলে সরকার এবং জনগণের মধ্যে একটি বিশাল ফাঁক তৈরি হয়েছে। এই ফাঁকই জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষের জন্ম দেয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল কোটা আন্দোলনের মাধ্যমে। যা শেষ পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনার সরকার পতন হয়।
প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য দায়বদ্ধ। এই অধিকার হরণ করা হলে ভবিষ্যতে একই ধরনের কর্তৃত্ববাদী সরকার আবারও ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাবে। তাই, ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি ঠেকাতে হলে আমাদের রাজনৈতিক এবং নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন, সরকারের জবাবদিহিতা, এবং শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া অন্যতম।
জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। যদি এই অধিকার নিশ্চিত করা যায়, তবে ভবিষ্যতে কোন কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে না এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সরকার বাধ্য থাকবে। সুতরাং, আমাদের এখনই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে গণতন্ত্র এবং মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকে।
এই প্রেক্ষাপটে, ভবিষ্যতে একটি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে সুষ্ঠু নির্বাচন ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার করা জরুরি। যাতে করে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার আর ফিরে আসতে না পারে এবং সরকারের জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়।
লেখক,
সহকারী বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের চেতনা
কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, সম্মিলিত সাংবাদিক পরিষদ
আপনার মতামত লিখুন :