বাংলাদেশে তুমুল গণ—অভ্যুত্থান হয়ে গেল। সরকারের নানাবিধ নেতিবাচক কাজ, দুনীর্তি, মানবাধিকার হরণ, অসদাচরণ ও বেসামাল কথাবার্তার কারণে মানুষের ভেতর কী গভীর ক্ষোভ জমা হয়েছিল, তারই বিস্ফোরণ ঘটল। উপমহাদেশে এমন গণ—অভ্যুত্থান এই প্রথম। ১৯৬৯ সালে ছাত্র—জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। সেই অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৬ জনের। গণ—অভ্যুত্থান পাকিস্তান সরকারকে বেশ কিছু দাবি মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। সেই সাথে ঘটে আইয়ুব খানের পতন। এরপর গণ—অভ্যুত্থান হয় ১৯৯০ সালে। সেই অভ্যুত্থানে পতন হয় আরেক মিলিটারি স্বৈরশাসক এরশাদের। দুটি গণ—অভ্যুত্থানেই ক্ষমতাসীনরা গুলি করে মানুষ হত্যা করে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল জনগণকে। মৃতের সংখ্যা খুব বেশি ছিলনা।
বাঙালিরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চায় না। সদ্য পতিত সরকারের কেউই সেই শিক্ষা নেয়নি। এমন কি নিজেদের যাবতীয় ব্যর্থতাকেও তারা স্বীকার করতে চায়নি। এখনো চাচ্ছে না। বরং ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়ে, আন্দোলনকে তুচ্ছ—তাচ্ছিল্য করে তাদের উসকে দেয় সরকার। জনগণের সরকার আন্দোলনরত ছাত্র—জনতার ওপর গুলি চালিয়ে শতশত জনকে হত্যা করে, মিলিটারি নামিয়ে, রাস্তায় ট্যাংক মোতায়েন করে কিভাবে চিন্তা করল যে তারা তাদের দমন করতে পারবে? কারণ তারাই তো রাজপথে আন্দোলন করে বারবার ক্ষমতায় এসেছে। ক্ষমতায় এসেই তারা রাজপথের আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছে। কী বিস্ময়কর! শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতনের পরও খুব কম আওয়ামীপন্থীই এত মৃত্যুর জন্য শোক প্রকাশ করেছে, কিংবা ক্ষমা চেয়েছে।
বাংলাদেশে যে গণ—অভ্যুত্থান হয়েছে, তার মধ্য দিয়ে আবারও রাজনীতিকদের নতুন করে চিন্তার পথ খুলে গেছে। যেমনঃ ১. জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায় না মৃত্যু—জেল—জুলুমের ভয় দেখিয়ে। ২. জনগণের সাথে অন্যায় আচরণ করলে তারা সময় ও সুযোগ মতো ফেটে পড়বেই। ৩. জনগণের মৌলিক প্রয়োজন না মিটিয়ে ক্ষমতাসীনরা রাষ্ট্রের তথা জনগণের সম্পদ লুটেপুটে নিলে জনগণ ছাড় দেয় না। ৪. জনগণের ওপর নির্যাতন বেড়ে গেলে তারা মরার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। একবার মরার জন্য প্রস্তুত হলে তাদের আর ঘরে ফেরানো যায় না।
এই গণ—অভ্যুত্থানে শত শত ছাত্র—জনতার মৃত্যু তাদের রাস্তা থেকে ঘরে ফেরাতে পারেনি। তারা আরো ফুঁসে উঠেছে। এবং ক্ষোভের আগুনে ভস্মীভূত হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। গণ—অভ্যুত্থানে শুধু দুটি পক্ষই থাকেনা। জনবিচ্ছিন্ন সরকার এবং জনগণ ছাড়াও অভ্যুত্থানের ডামাডোলে আরো অনেক পক্ষ তৈরি হয়ে যায়, যারা সুবিধালোভী, সুযোগসন্ধানী, লুটেরা, ধান্ধাবাজ, চোর—বাটপার ইত্যাদি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারও তার প্রতিপক্ষের কাঁধে দোষ চাপিয়ে দেয়ার জন্য তাদের পেটোয়া বাহিনী, আগুন সন্ত্রাসী, স্বার্থান্বেষী এবং এই শ্রেণীর গুন্ডাবাজকে রাস্তায় লেলিয়ে দেয়। ফলে গণ—অভ্যুত্থানে যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে, তার সবই বিক্ষুব্ধ জনগণের দ্বারা হয় না।
যুগ যুগ ধরে দেখা গেছে, এত শক্তি থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরা হেরে যায়। তখন ক্ষমতাসীন প্রধানকে তার সহযোগীসহ হত্যা করা হয় কিংবা তিনি অন্যদের নিয়ে পালিয়ে গিয়ে বাঁচেন। বাংলাদেশের এই অপরিণামদশীর্, কতৃর্ত্ববাদী নেত্রী নিজে বা তার কয়েকজন সহযোগী বাঁচলেও তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সতীর্থ, নেতা, কর্মী, সমর্থকদের অগ্নিবলয়ের মধ্যে ফেলে পালিয়ে গেলেন। একজন নেতার জন্য এই পালিয়ে যাওয়া ঘৃণ্য তো বটেই, এটা তার জন্য আত্মাহুতিও। জনগণই যেহেতু রাজনীতির মূল নিয়ামক, তাই জনগণকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া কোনো রাজনীতিকের সিদ্ধান্ত হতে পারে না। যদি হয়, তখন তাকে ‘রাজনীতিক’ বলা যায় না।
গণ—অভ্যুত্থানের পরের যে ভাঙচুর এবং জ্বালাও—পোড়াও সেটাও গণ—অভ্যুত্থানেরই অংশ। অভ্যুত্থান যত প্রচন্ডতা তৈরি করে ক্ষতিও তত বেশি হয়। গণঅভ্যুত্থানের শক্তি আরো প্রমাণিত হয়, যখন সারাদেশে পুলিশ বাহিনী অস্ত্র ফেলে দ্রুত পালিয়ে যায়।
বাংলাদেশে এই ছাত্র—জনতার গণ—অভ্যুত্থানের ব্যাপকতা যদি কেউ পরিমাপ করতে ভুল করেন, তিনি অযোগ্য। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে, এই রকম গণ—অভ্যুত্থানকালে ও পরবতীর্ পর্যায়ে নানা পক্ষ তৈরি হয়। তারা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক, স্বার্থান্বেষী ও সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা হাসিল করতে তৎপর হয়। তারা ভুলে যায় হিন্দুরাও মানুষ, তাদের মন্দিরে আঘাত হানলে তা তাদের হৃদয়কে ছাড়খার করে দেয় এবং তারা সংখ্যায় অল্প হওয়ার কারণে পুলিশের অনুপস্থিতিতে (এমন কি পুলিশ থাকলেও) আক্রমণকারীরা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে তাদের নানা স্বার্থ হাসিল করে। আক্রমণকারীরা ভুলে যায় বাংলাদেশ তাদেরও দেশ, মুক্তিযুদ্ধে তাদেরও হতে হয়েছে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন। যারা দেশের সম্পদ ভাঙচুর করেছে জ্বালিয়ে পুড়িয়েছে তারা জানেও না তাদের অপরাধ কতটা ঘৃণ্য এবং গভীর। এ সবই দেশের সম্পদ। এই সব কিছুর লিগাসি এবং গৌরবের ভাগিদার সেও।
গণ—অভ্যুত্থান দেশের জনগণের কল্যাণার্থে হয়ে থাকে। যারা আজ দেশের ভার গ্রহণ করেছেন, তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, আপনারা দেশের স্বার্থই আগে দেখুন, জনগণের মঙ্গলই আগে কামনা করুন।
জনগণ আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
লেখক,
সাংবাদিক
আপনার মতামত লিখুন :