বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। তবে স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে গেলেও পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের চালানো ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন রয়ে গেছে সারাদেশে। তারই স্মৃতি বহন করে চলছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার কোল্লাপাথর শহীদ সমাধিস্থল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্ব প্রান্তে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সিপাহী জেলার বিশালগর থানার পশ্চিমে সীমান্তবর্তী কসবা উপজেলা। এই উপজেলার রয়েছে লাল মাটির পাহাড়ি টিলা ভূমি। ছোট ছোট টিলার সবুজ বনানী আর পশ্চিম প্রান্তে সমতল ভূমির সৌন্দর্য্যরে এক ঐতিহ্যবাহী স্থান কসবা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমান্ত-অঞ্চল ‘কসবা উপজেলা’র নাম কেউ শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কসবা উপজেলার একটি গ্রামের নাম ‘কোল্লাপাথর’। কোল্লাপাথর গ্রামের একটি টিলার ওপর ঘুমিয়ে আছেন স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হওয়া ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদ হওয়া ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে দুইজন বীর উত্তম, দুইজন বীরপ্রতীক এবং একজন বীর বিক্রম উপাধি পাওয়া যোদ্ধার সমাধি রয়েছে। এ ছাড়া ৫০ জনের মধ্যে তিনজন অজ্ঞাত বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি রয়েছে। যাদের পরিচয় আজও পাওয়া যায়নি।
বীর শহীদদের সমাধি সৌধ ‘কোল্লাপাথর’ এর পুরো ইতিহাসের সাক্ষী হচ্ছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম। তিনি কিছুই লিখে রাখেননি, কিন্তু ১৯৭১ সাল থেকে এ সমাধিস্থল সংরক্ষণ এবং উন্নয়নের জীবন্ত সাক্ষী তিনি। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিমের বাবার দেওয়া জমিতেই এ সমাধি সৌধ নির্মিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম তার ২০২১ সালে করোনায় মৃত্যুর পর তার ছেলে মাহাবুব করিম এখন সমাধি সৌধের তত্ত্বাবধান করছেন।
ইতিহাসের বিভিন্ন পাতা থেকে জানা গেছে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় কোল্লাপাথর অঞ্চলটি ছিল মুক্তাঞ্চল। পাক হানাদার বাহিনী কখনোই এই অঞ্চলে ঢুকতে পারেনি। নিরাপদ স্থান হিসেবে তাই জীবন দানকারী বীর যোদ্ধাদের ‘কোল্লাপাথর’ এ সমাহিত করা হয়।
পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কোল্লাপাথরের ইতিহাস সংরক্ষণ করতে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। শহীদদের সমাধিগুলোর চারপাশ লাল ইটের বেদিতে ঢেকে দেওয়া হয়। ৫০ জন শহীদের নাম ঠিকানার (যতটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে) একটি বড় ফলক নির্মাণ করা হয়।
কোল্লাপাথর’এ সমাহিত করা বীর যোদ্ধাদের কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগই নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্য। অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত নন কমিশন্ড অফিসার বা সিপাহী। একাত্তরের ওই সময়ে এই বীর যোদ্ধারা নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য জীবন দিতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশে আজকের এই সময়ে এতদিন পর কেউ হয়ত অনুভব করতে পারবেন না বীর যোদ্ধাদের ওই সময়ের অনুভূতি, চেতনা, যা তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল নিদ্বির্ধায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে।
মুক্তিযুদ্ধে পুরো বাংলাদেশ রণাঙ্গণকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। দুই নম্বর সেক্টরটি ছিল ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত বিরাট এলাকা জুড়ে। কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফরিদপুর আর ঢাকার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় দুই নম্বর সেক্টর। কোল্লাপাথর দুই নম্বর সেক্টরেরই একটি অংশ ছিল। দুই নম্বর সেক্টরকে ছয়টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। যার মধ্যে তিনটি সাব-সেক্টর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা।
কোল্লাপাথরে যে ৫০ জন শহীদ ঘুমিয়ে আছেন তাদের প্রায় সকলেই দুই নম্বর সেক্টরের তিনটি সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করে শহীদ হন। হাবিলদার তৈয়ব আলী হচ্ছেন প্রথম শহীদ, যাকে সর্ব প্রথম কোল্লাপাথরের সমাধিতে সমাহিত করা হয়।
‘কোল্লাপাথর’ এ যে ৫০ জন বীর শহীদ ঘুমিয়ে আছেন, তারা হচ্ছেন, ঠাকুরগাওয়ের সৈনিক দর্শন আলী, আর কে মিশন রোড ঢাকার মোঃ জাকির হোসেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল জব্বার, সিলেটের হাবিলদার তৈয়ব আলী, বগুড়ার ল্যান্স নায়েক আবদুস সাত্তার (বীর বিক্রম), কুমিল্লার সিপাহী আক্কাছ আলী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. ফকরুল আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. ফারুক আহম্মদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোজাহিদ নুরু মিয়া, ময়মনসিংহের নায়েক মোজাম্মেল হক, নোয়াখালীর নায়েক সুবেদার মো. আবদুল সালাম (বীর বিক্রম), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. নোয়াব আলী, ফরিদপুরের সিপাহী মুসলীম মৃধা, শরিয়তপুরের প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল অদুদ, কুমিল্লার সিপাহী জসিম উদ্দীন, কুমিল্লার মো. আবদুল কাসেম (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী), কুমিল্লার মো. মোশারফ হোসেন, কুমিল্লার নায়েক সুবেদার মইনুল হোসেন (বীর উত্তম), চাঁদপুরের সিপাহী মো. নুরুল হক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল কাইয়ুম, কুমিল্লার সিপাহী সিপাহী হুমায়ুন কবির, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ল্যান্স নায়েক মো. আ. খালেক, কুমিল্লার ল্যান্স নায়েক আজিজুর রহমান, কুমিল্লার মো. তারু মিয়া, চট্টগ্রামের নায়েক সুবেদার বেলায়েত হোসেন (বীর উত্তম), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. রফিকুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. মোরসেদ মিয়া, কিশোরগঞ্জের শ্রী আশু রঞ্জন দে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. তাজুল ইসলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. শওকত, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুস সালাম সরকার, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আমির হোসেন, চাঁদপুরের মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শ্রী পরেশ চন্দ্র মল্লিক, কুমিল্লার মো. জামাল উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুল আউয়াল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. জাবেদ আহাম্মদ, কুমিল্লার মো. সিরাজুল ইসলাম, কুমিল্লার মো. ফরিদ মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. মতিউর রহমান, কুমিল্লার মো. সাকিল মিয়া, চাঁদপুরের আনসার ইলাহী বক্স পাটোয়ারী (বীর প্রতিক), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মো. আবদুর রশিদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিপাহী শহিদুল হক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিপাহী আনোয়ার হোসেন, কুমিল্লার সিপাহী মো. আবদুল বারী খন্দকার এবং অজ্ঞাত তিনজন।
প্রতিদিন দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে লোকজন আসে এই এলাকায় ঘুরতে। সমাধিস্থলকে ঘিরে একটি পর্যটন স্পট গড়ে উঠেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিষদ কর্তৃক সমাধিস্থলের পাশে পর্যটকদের জন্য অত্যাধুনিক ডাকবাংলো ও মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে।
ভিসি/এমকে
আপনার মতামত লিখুন :