দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদে আসীন হইবার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণের যে উদ্যোগ শিক্ষা প্রশাসন গ্রহণ করিয়াছে, তাহা সাধুবাদ পাইবার যোগ্য। কিন্তু উক্ত সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক নির্ধারণ করিবার আয়োজন হইতেছে বলিয়া রবিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদনে যাহা বলা হইয়াছে, উহা বিষয়কে প্রশ্নের মুখে ফেলিয়াছে।
ইতোমধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হইবার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা নূ্যনতম স্নাতক পর্যায় নির্ধারণ করা হইয়াছে। এক্ষণে মাধ্যমিক বিদ্যালয় কিংবা কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নির্বাচন করিবার ক্ষেত্রে আরও কম যোগ্যতার বিষয়টি নিঃসন্দেহে খারাপ দৃষ্টান্ত হইয়া থাকিবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ বলিয়াই উহাদের গ্রহণযোগ্য মাত্রার শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন। ফলে বিষয়টা উপেক্ষা করিবার কোনো অবকাশ নাই। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সাল হইতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি হইবার যোগ্যতা স্নাতক নির্ধারণ করিবার পর প্রাথমিক শিক্ষায় অনেকাংশে শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসিয়াছে।
বলা চলে, উহার সূত্র ধরিয়া বিভিন্ন মহল হইতে মাধ্যমিকে ও কলেজেও সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করিয়া দিবার দাবি উঠিয়াছে। এই সকল দাবির আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় উদ্যোগ গ্রহণ করিলেও মাধ্যমিক ও কলেজের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটি প্রবিধানমালায় সভাপতির যোগ্যতা এইচএসসি নির্ধারণের হেতু কী?
সমকালের প্রতিবেদকের নিকট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানাইয়াছেন, তাঁহারা শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রথমে স্নাতক নির্ধারণের বিষয়টিই বিবেচনায় লইয়াছিলেন। পরে শিক্ষাগত যোগ্যতা হ্রাসকরণের নির্দেশনা আসে ‘উপর’ হইতে। উপর বলিতে যাহাই বোঝানো হউক, ইহার মাধ্যমে যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অযোগ্য নেতাদের এক প্রকার করিয়া খাইবার সুযোগ উন্মুক্তকরণের আয়োজন করা হইতেছে, তাহা অনুধাবন করা কঠিন নহে। অতীতে এহেন রাজনৈতিক নেতাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সুখকর হয়নি। এতদ্ব্যতীত ইহাও বলা প্রয়োজন, শিক্ষানীতি-২০১০ এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দলীয় রাজনীতির বাহিরে রাখিবার সুপারিশ করা হইয়াছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কমিটি গঠিত হইবার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যেমন অস্বচ্ছতার অভিযোগ পাওয়া গিয়াছে, তদ্রূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় নানা অনিয়মের পথও প্রশস্ত হইয়াছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থাপনা কমিটির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নতির বিপরীতে বরং অধোগতি ঘটিবার দৃষ্টান্তও এন্তার।
বলিবার অপেক্ষা রাখে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত ও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে পরিচালনা কমিটিকে বাস্তব, উদ্ভাবনমূলক এবং যুগোপযোগী বহুবিধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে হয়। তজ্জন্য কমিটির সদস্য বিশেষ করিয়া সভাপতিকে যেমন জ্ঞানসম্পন্ন হইতে হয়, তদ্রূপ তাহার পরিস্থিতি অনুধাবনের সামর্থ্য এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণের যোগ্যতাও থাকা প্রয়োজন। স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করিবার মাধ্যমে ব্যক্তির যে অভিজ্ঞতা হয়, উহা নিঃসন্দেহে এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রবিধানমালায় প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি, ভবন, খেলার মাঠ, পুস্তকসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা; প্রতিষ্ঠানের তহবিল সংগ্রহ, ব্যবস্থাপনাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি ও পরিচালনা পর্ষদের নির্দিষ্ট কিছু দায়িত্বের বিষয় উল্লেখ রহিয়াছে। এই সকল দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনের স্বার্থেই এক দল যোগ্য ব্যক্তিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য মনোনীত কিংবা নির্বাচিত করা উচিত এবং এই ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসাবে নূ্যনতম স্নাতক নির্ধারণ জরুরি বলিয়া আমরা মনে করি।
আমাদের বিশ্বাস, শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বশীলগণ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করিবেন। এই ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের রাজনীতিকদেরও সদিচ্ছা প্রয়োজন।
মনে রাখিতে হইবে, আমাদের মানবসম্পদ উন্নয়নে মানসম্পন্ন শিক্ষার বিকল্প নাই এবং এই ক্ষেত্রে ছাড় দিবার কারণে আমাদের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হইতে বাধ্য। এতদ্ব্যতীত প্রাথমিক শিক্ষা যে পথ দেখাইয়াছে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কেন তাহার উল্টা পথে হাঁটিবে?
সূত্রঃ সমকাল
আপনার মতামত লিখুন :